আমার কর্মজীবনের শুরুটাই হয়েছিল ওয়ালটন দিয়ে, আর দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল ১৪ বছর। অনেকেই যেখানে উন্নতি বা স্বীকৃতির জন্য প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেন, সেখানে আমি বরং প্রাপ্য সম্মান ও সুযোগ স্বাভাবিকভাবে পেয়েছি, এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত এসেছে। কর্মজীবনের শুরুতে এমন একটি পরিবেশে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল, যেখানে দলাদলি বা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির তেমন প্রভাব ছিল না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্পোরেট হাউজের জটিল বাস্তবতা ও বিভিন্ন ‘অদৃশ্য’ বলয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এসব অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শেখার সুযোগ হয়েছে। এখন আমি অনেক বেশি ব্যালেন্সড। একটা কর্পোরেট বোমাকে নিউট্রাল করা কিংবা কর্পোরেট ওয়েদার ফোরকাস্ট করা আমার সক্ষমতার অংশ। এই পথচলা আমাকে শুধু পেশাগতভাবে নয়, একজন পরিপূর্ন সচেতন পেশাজীবী হিসেবেও গড়ে তুলেছে। 

প্রথম পাঁচ বছর ছিলাম প্লাজার একজন সফল এরিয়া ম্যানেজার। সেই সময় ইনসেনটিভ, পুরস্কার—কোনোটিই আমার ক্যালেন্ডার থেকে মিস হয়নি। এরপর আমি যুক্ত হই ইলেকট্রিক অ্যাপ্লায়েন্স (EAP) বিভাগে। শুরুর দিকে এই পণ্য নিয়ে একে একে চারটি জেনারেশন ব্যর্থ হয়েছিল,এরপর ম্যানেজমেন্ট আমাদের চারজন সেরা পারফরমারকে প্লাজার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নতুন করে প্লাজা-EAP টিম গঠন করে দেয়। এই চারজনের মধ্যে আমি ছিলাম একজন, এবং শুরু থেকেই আমাদের মধ্যে চলতে থাকে গঠনমূলক প্রতিযোগিতা। প্রথমেই সবার মধ্যে ভালো পারফরম্যান্স করে টিম লিডার বা হেড হিসেবে নির্বাচিত হই। পরে EAP প্লাজা থেকে পুরোপুরি আলাদা হয়ে "EAP ডিস্ট্রিবিউটর নেটওয়ার্ক" নামে নিজস্ব চ্যানেল হিসেবে পথচলা শুরু করে। সারাদেশকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়, এবং তার এক ভাগের নেতৃত্ব দেওয়া হয় আমাকে। তিনজন হেডের মধ্যে পারফরম্যান্সে আবারো এগিয়ে থেকে আমি নির্বাচিত হই অপারেশন হেড হিসেবে। এরপর যোগ দেন বিখ্যাত এক বস। নতুন করে শুরু হয় আরও এক প্রতিযোগিতা—এইবার একজন ইন্ডাস্ট্রি-স্বীকৃত দক্ষ নেতার সঙ্গে। দেশকে দুইভাগে ভাগ করা হয়—এক ভাগ আমার। টেকনাফ আর তেঁতুলিয়া—দুইটাই আমার দায়িত্বের আওতায় আসে। অনুমান করা যায় ভাগটা কেমন ছিল! সত্যি বলতে, আমার ভাগটিই ছিল তুলনামূলক ব্যবসা-বান্ধবহীন ও পিছিয়ে থাকা অঞ্চল। তবুও, পরবর্তী তিন বছর আমি কোনো মাসেই পিছিয়ে পড়িনি। এই নিরবচ্ছিন্ন সফলতার ফলেই, বিখ্যাত বসের প্রস্থানের পর দুইজনের মধ্য থেকে আমাকেই নির্বাচিত করা হয় ইন্ডাস্ট্রির সর্বকনিষ্ঠ ‘হেড অফ সেলস’ হিসেবে।

তখন দায়িত্বে ছিল একটি প্রায় অগোছালো, বন্ধ হওয়ার মুখে থাকা ডিপার্টমেন্ট। নিজের সর্বোচ্চ ডেডিকেশন দিয়ে সেটিকে পুনর্গঠিত করি। গুছিয়ে ওঠার মাত্র এক বছর পর আবার দেশ দুই ভাগে ভাগ হয়—এইবারেও এক ভাগ আমার, তবে এবার আর কোনো বস নেই—রাসরি রিপোর্টিং ম্যানেজমেন্টকে। এরপর ইন্ডাস্ট্রির আরও একাধিক হাই-প্রোফাইল এক্সপেরিয়েন্সড লোক আমার বিপরীতে আসেন, যান, আবার আসেন। তবুও, গত ৫ বছরে আমি প্রথম হয়েছি এবং এখনও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছি।



ক্যারিয়ার নিয়ে আমার ৩টি অটল বিশ্বাস

একজন পেশাজীবী হিসেবে দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা থেকে আমি তিনটি বিষয় গভীরভাবে বিশ্বাস করি। এগুলো আমার পথচলার ভিত, এগুলোই আমাকে বারবার এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে।

) সার্ভিস — সমস্যা শুনুন, সমাধান দিন

আমার প্রথম বিশ্বাস: সার্ভিস বা সমাধান সরবরাহ সেলসের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
সমস্যা যত কমবে, সেলস তত বাড়বে—এটাই বাস্তবতা। তাই প্রতিনিয়ত সমস্যা খুঁজে বের করতে হবে, তার সমাধানে কাজ করতে হবে।

  • অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব কথা বলতে হবে।
  • সমস্যা জেনেও তাকে পাশ কাটানো যাবে না।
  • চেইন অফ কমান্ড ভাঙা যাবে না।

একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিতে আমি বিশ্বাস করি:
"হয় সমস্যা থাকবে, না হয় অফিসার। দুটো একসাথে চলবে না।"

টিমে যদি কেউ সমস্যা তৈরি করে, তাকে শনাক্ত করতে হবে। আবার যারা ভালো করছে—তাদের সম্মান, প্রাপ্তি এবং মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

আমার নিজের অভিজ্ঞতায় যেমন:
প্রথম EAP পণ্যে আসার পর দুই মাসেই আমি চরম হতাশ হয়ে পড়েছিলাম—পণ্য নেই, মার্কেট নেই, লোক নেই, সেলস নেই। আমি সরাসরি চেয়ারম্যান স্যারের কাছে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, "আমার দ্বারা হবে না!" উনি হেসে বলেছিলেন: "আমিও পারি না! আপনি বেচতে বেচতে শিখে যাবেন, আমি বানাতে বানাতে।" এই কথাই আমার মনোবল ফিরিয়ে দিয়েছিল।

বিখ্যাত বস চলে গেলে আমি যখন দায়িত্ব পাই সময়টা খুব কঠিন ছিল—১১০টি পার্টনার চেকবিহীন বাকী দেয়া , বাজারে মোট ৫৬ কোটি টাকার বাকি, মাসিক সেলস মাত্র ৮ কোটি!
আবারো চেয়ারম্যান স্যার ভরসা দিলেন। বললেন, "চেক গুলো নিয়ে আসেন, বাকির ওপর নীতিমালা তৈরি করুন।"
তারপর থেকে আমি আর পেছনে তাকাইনি। আজ ইএপি ইন্ডাস্ট্রির দ্বিতীয় অবস্থানে—এটি আমার জন্য গর্বের বিষয়।


২) অসাধারণ হতে গেলে, করতে হবে ব্যতিক্রম কিছু

আমার দ্বিতীয় বিশ্বাস: সাধারণ কাজ করে কেউ অসাধারণ হতে পারে না।
আমি সবসময় আমার সমপর্যায়ের সহকর্মীদের চেয়ে কিছুটা বেশি করি—অফিস টাইমের বাইরেও কাজ করি, রাতে মিটিং করি, নিজ উদ্যোগে রিপোর্ট করি, এক্সট্রা এফোর্ট দিই।

মাইকেল ফেলপস বলেছিলেন,
"সবার চেয়ে আমি সপ্তাহে একদিন বেশি প্র্যাকটিস করি। বছরে ৫২ দিন এগিয়ে থাকি।"
এই নীতিই আমাকে আত্মবিশ্বাস দেয়।

সাফল্য আসে না নিজে নিজে, তাকে দৌড়ে গিয়ে ধরতে হয়।
ওয়ালটনের মতো একটি প্রতিষ্ঠান এমনি গড়ে ওঠেনি—এখানে মেধা, পরিশ্রম, ঘাম ও আত্মত্যাগ লুকিয়ে আছে।
আমার উপলব্ধি হলো—মেধা আর শ্রম ছাড়া উন্নতির কোনো শর্টকাট নেই। আর যদি আপনি জীবনে অবস্থানগত পরিবর্তন না আনতে পারেন, এক সময় জীবনের সেই একঘেয়েমি আপনাকে হতাশ করে তুলবে, আপনি স্বপ্ন দেখা ভুলে যাবেন।


৩) শিখুন—সামর্থ্য বাড়ান

আমার তৃতীয় বিশ্বাস: প্রত্যেক মানুষ তার সামর্থ অনুযায়ী সফল, কিন্তু সেই সামর্থ্য প্রতিদিন বাড়াতে হবে।

  • বিল গেটস এখনো প্রচুর বই পড়েন।
  • স্টিভ জবস ক্যালিগ্রাফি শিখেছিলেন, যা পরে ম্যাক ও উইন্ডোজে টাইপোগ্রাফির বিপ্লব ঘটায়।
  • ইলন মাস্ক রকেট বানানোর আগে রকেট বিজ্ঞান পড়েছেন—তখনই, যখন প্রয়োজন ছিল।

এই তিনজনই প্রমাণ করেন—শেখার আগ্রহই সবকিছু।

আমি নিজেও বুঝেছিলাম—এক্সেলে দক্ষ না হলে আমি পিছিয়ে পড়ব। তাই কখনো সিনিয়র, কখনো জুনিয়র, আবার কখনো গুগল বা ইউটিউব থেকে শিখেছি। এক্সেলে মিড-লেভেল পারদর্শিতা অনেক আগেই অতিক্রম করেছি।

২০১৯ সাল থেকে দেখলাম—গুগল শীট আরও কার্যকর। তাই নিজেকে গড়ে তুলেছি: Google Sheet, Docs, Slides, Sites, Forms—সবকিছুর এক্সট্রিম লেভেলের ইউজার হিসেবে।

সময় বের করা কঠিন, কিন্তু শেখা থামাইনি।
আজও সময় পেলেই নতুন কোর্স এনরোল করি—আর চেষ্টা করি শেখার সেই জার্নি চালিয়ে যেতে।


Md. Faruque Hossain
Sales team & tools specialist



Post a Comment

Previous Post Next Post